![]() |
সুন্দরবনের জীবজন্তুদের রেস্তোরা - বিপ্লব দাশ |
সুন্দরবন
অসংখ্য গাঙনদী খাড়ি খালে ভর্তি বাদাবন। সমুদ্রের সঙ্গে নদী আর নদীর সঙ্গে এ বনের
কোনাকুনি হওয়ার ফলে প্রচুর পরিমাণে লোনাপানির পলি যেমন জমে তেমনি আবার পানির
তোড়ে ধুয়ে যায় বনভূমি। সে-কারণে এ বনের বাসিন্দা প্রাণিকুল পানিতে, কাদায়
বা ডাঙায় বেড়ে ওঠে এবং বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে।। প্রাণীদের কথা উঠলে সকলের
আগে নাম করতে হয় বাঘের।
সুন্দরবনের প্রাণীদের মধ্যে কুলীন হল বাঘ। সুন্দরবনের বাঘ! পৃথিবী জুড়ে
কিংবদন্তিসম্পন্ন যার নাম। প্রকৃতির
এক অনবদ্য সৃষ্টি। বড় বড় নদী অনায়াসে সাঁতার কেটে পার হয়ে যায়। পানিতে, ডাঙায়
সর্বত্রই ওদের যাতায়াত। চোরাচালানি বা স্মাগলারদের মতো। টাইগার আর স্মাগলার একই আবাসে না-থাকলে অনুপ্রাসে এসে এরা মেলে। দুটি বা
তিনটি বাঘ মিলে একটি পরিবার। সুন্দরবনের বাঘের নিজস্ব কোনো সীমাবদ্ধ গণ্ডি নেই। এই
গণ্ডি না-থাকার ফলে বাঘের অবাধ চলাফেরা এবং চাউনির মধ্যে একটা রাজকীয় দৃপ্তভঙ্গি
দেখা যায়। তাই বুঝি এরা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। প্রকৃতিরাজ্যে নিয়মটা একটু
বিচিত্র। এখানে খাদ্য-খাদক একসঙ্গে বাস করে। শত্রুমিত্র একই প্রতিবেশী। বাঘের এলাকাতেই বাস করে বুনোশুয়োরের দল। এরা সংখ্যায় অনেক
কম। বুনোশুয়োর মাটির নিচের সব-ধরনের কন্দ খেলেও এরা মাছ, শামুকজাতীয়
নরম প্রাণীও পছন্দ করে বেশি।
সুন্দরবনের
বাঘের এলাকাতেই আবার চিতল হরিণের বাস। ভিজে মাটি আর লোনাপানিতে বেঁচে থাকার অদ্ভুত
ক্ষমতা এদের। লোনাপানি খেয়ে সেই নুন চোখের দুপাশ দিয়ে বের করে দেয়। এখানকার
হরিণেরা গেওর বাইন (সত্যজিতের বাঘা-বাইন নয়), কেওড়া গাছের পাতা যা
নাগালে পায় তাই ছিড়ে খায়। মর্কট নামে এক জাতীয় বাঁদর কেওড়া গাছের কচিপাতা
ছিড়ে দেয়। চিতল হরিণদের। এরা সেগুলি খায়। আবার বাঘ এদের খেতে এলে মর্কটদল
সাংকেতিক আওয়াজ করে জানিয়ে দেয়। ভাবটা এমন—এবার সতর্ক
হয়ে যাও তোমরা, এখুনি বাঘ আসবে।
মর্কট
বাঁদরের পেটে লোনাপানি একদম সয় না। অথচ লোনা আবহাওয়ায় বেমালুম জীবন কাটাতে হয়।
এরা বাঘের খুব পছন্দসই খাদ্য। সব ঋতুতেই বাঘের মুখ বদলাতে সাহায্য করে এরা। স্বভাবে
খুবই লাজুক। বাঘের কারসাজির কাছে বেজায় নিরুপায়।
মেছো-বিড়াল, হয়তো
নাম অনেকেই শুনেছ। চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি। এদের চেহারা বাঘের মতোই অনেকটা। সুন্দরবনের কোনো জায়গায় আকস্মিক দেখা হলে গা-কাঁটা দিয়ে উঠবে। হৃৎপিণ্ড একলাফে গলার কাছে চলে আসবে। বাঘ না-হলেও বাঘের দূর-সম্পর্কীয়
আত্মীয় বলে চিনতে ভুল হবে না তোমার। লম্বায় পাঁচ ফুটেরই বেশি। উচ্চতায় তিন ফুট।
কিন্তু যেটা আশ্চর্যের বিষয়— এরা এদের থেকে চারগুণ
আয়তনের বড় প্রাণীকে অনায়াসে কাবু করতে পারে। বুনোশুয়োর, মাছ, শিশু চিতল এবং
বাঘের ভুক্তাংশ দিয়ে খাওয়াদাওয়ার পাট চোকায়। সুন্দরবনের এলাকার মানুষেরা মেছো-বিড়ালের
আতঙ্কে ইয়া-নপসি জপে।
কৃষ্ণ
গোধিকা বললে চিনবে না অনেকেই। জলজ গো-সাপ চেনো হয়তো। সুন্দরবন এলাকায়। ওদের আটপৌরে নাম গোড়কেল। দেখতে অনেকটা ড্রাগনের মতো। ইন্দোনেশিয়ার কমোডো ড্রাগন এদেরই নিকট আত্মীয়। লম্বায় আট ফুটেরও বেশি। মুখের সামনের দিকটা পাখির ডিম আর সামুদ্রিক
কচ্ছপের ডিম এদের প্রিয় খাদ্য। এদের গায়ের রক্ত বেশ ঠাণ্ডা। কিন্তু সেই ঠাণ্ডা
রক্তই বাঘের খাদ্যতালিকা বা মেনুতে রয়েছে।
.কুমির অনেকেই দেখেছ। সুন্দরবনের খাড়ির কুমির সাধারণত মেছো নয়। মেছো কুমির
পনেরো ফুটের বেশি লম্বা হয় না। কিন্তু খাড়ির কুমির বাইশ-তেইশ ফুটের বেশি লম্বা
হয়। এদের প্রতিবছর চার-পাঁচজন মানুষ চাই। নইলে মন ভরে না।
বিড়ালজাতীয়
কচ্ছপ দেখেছ কেউ? না-দেখলে চলো যাই সুন্দরবনে। শীতকালে এরা ডিম
পাড়তে ডাঙায় উঠে আসে। এদের পা নেই কিন্তু পায়ের জায়গায় পাখনা আছে। পানি কেটে
সমুদ্রে সাঁতার দেয়। সাগরের রূপচাঁদা এদের কাছে অপরূপ স্বাদের খাবার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন